বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি। দুপুরবেলা, চারপাশে নিস্তব্ধতা। নীলা হাতে একটা বই খুঁজছিল—রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা। হঠাৎই অন্য দিক থেকে একটা হাত বাড়িয়ে একই বইটা ধরল। চমকে উঠে তাকিয়ে দেখে, এক লম্বা, হাসিখুশি চোখওয়ালা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।
আরিয়ান: “ওহ! সরি… তুমি আগে নিতে পারো।”
নীলা: (হালকা হেসে) “না, তুমি নাও। আমি অন্য কপি খুঁজে নেব।”
আরিয়ান: “তাহলে একটা সমাধান করি, বইটা আমরা একসাথে পড়ব।”
নীলা: (ভ্রু কুঁচকে) “একসাথে? অপরিচিত কারও সঙ্গে?”
আরিয়ান: “অপরিচিত তো আজ। কাল হয়তো আমরা বন্ধুও হতে পারি।”
নীলা অবাক হয়েছিল, কিন্তু অজানা এক টানে রাজি হয়ে গেল। সেদিন থেকেই তাদের আলাপের শুরু।
বন্ধুত্বের দিনগুলো
দিন গড়াতে লাগল। ক্লাস শেষে ক্যান্টিনে চা, লাইব্রেরিতে পাশাপাশি বসে পড়াশোনা, ক্যাম্পাসের পথে গল্প করতে করতে হাঁটা—সবই যেন এক অদ্ভুত অভ্যাসে পরিণত হলো।
নীলা: “তুমি সবসময় হাসো কেন? কোনো দুঃখ নেই নাকি তোমার?”
আরিয়ান: “দুঃখ আছে, কিন্তু আমি কাউকে দেখাতে চাই না। আমি চাই, মানুষ আমার হাসিতে স্বস্তি পাক।”
নীলা: (মুচকি হেসে) “তাহলে তোমার হাসির ভেতরেও একটা গল্প আছে, তাই না?”
আরিয়ান: “হ্যাঁ, আর সেই গল্পের একটা অধ্যায় তুমি।”
নীলা কিছু বলল না, কিন্তু বুকের ভেতর কেমন যেন কাঁপল। সে বুঝতে শুরু করল, বন্ধুত্বের বাইরে আরও কিছু অনুভব জন্ম নিচ্ছে।
অপ্রকাশিত টান
দিনগুলো যতই এগোতে লাগল, নীলা ততই বুঝতে পারছিল, আরিয়ানের জন্য ওর অনুভূতিটা বদলে গেছে। বন্ধুত্ব যেন আর কেবল বন্ধুত্ব নেই। কিন্তু সাহস হচ্ছিল না কিছু বলার।
একদিন বৃষ্টিভেজা বিকেলে তারা দু’জনে ক্যাম্পাসের ভেতর হাঁটছিল।
নীলা: “তুমি কি কখনও ভেবেছো, বন্ধুত্বেরও একটা সীমা আছে?”
আরিয়ান: (হতভম্ব) “মানে?”
নীলা: “মানে, হয়তো বন্ধুত্ব থেকে… আরেকটা অনুভূতি জন্ম নিতে পারে।”
আরিয়ান: (হালকা হেসে) “হয়তো। কিন্তু তখন যদি ভয় পাই?”
নীলা: (চোখ নামিয়ে) “ভয় তো আমিও পাই।”
দু’জনেই চুপ হয়ে গেল। শুধু বৃষ্টির শব্দ ভেসে আসছিল।
দ্বিধা
রাতে নীলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছিল। ফোনে নোট খুলে লিখছিল, “আমি চাই তাকে বলি, কিন্তু ভয় পাই। যদি সে আমার মতো না ভাবে? যদি সে দূরে সরে যায়?”
পরের দিন দেখা হলে, আরিয়ান জিজ্ঞেস করল—
আরিয়ান: “তুমি এত চুপচাপ কেন?”
নীলা: “কিছু না। শুধু… কখনও কখনও মনে হয় কথা না বলাই ভালো।”
আরিয়ান: “কিন্তু না বললে, কি মনটা হালকা হয়?”
নীলা: (চোখ এড়িয়ে) “হয় না।”
স্বীকারোক্তির দিন
সেদিনও হালকা বৃষ্টি হচ্ছিল। ক্যাম্পাস ফাঁকা। নীলা গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ পিছন থেকে ভেজা কণ্ঠ ভেসে এলো।
আরিয়ান: “নীলা, আজও কি তুমি আকাশ দেখে গল্প লিখছো?”
নীলা: (চমকে ঘুরে) “তুমি? ভিজে গেছো তো!”
আরিয়ান: “ভিজতে আপত্তি নেই, কিন্তু তোমাকে হারানোর ভয়টা সহ্য করতে পারি না।”
নীলা: (হতবাক) “মানে?”
আরিয়ান: “মানে, আমি আর লুকোতে চাই না। আমি চাই, তোমার প্রতিটি গল্পে আমি থাকি। আমি চাই, তোমার জীবনের জানালা দিয়ে তাকালে আমাকে দেখতে পাও।”
নীলা চুপ। চোখ ভিজে উঠল।
নীলা: (কণ্ঠ কাঁপছে) “তুমি জানো না, আমি কতদিন ধরে এই কথার অপেক্ষায় ছিলাম।”
আরিয়ান: “তাহলে বললে না কেন?”
নীলা: “ভয় পেতাম। যদি তুমি না বলো?”
আরিয়ান: (হেসে) “পাগল! আমি না বলার মতো মানুষ নই। আমি তো প্রথম দিন থেকেই তোমার চোখে খুঁজে ফিরেছি আমার ঠিকানা।”
দু’জনেই একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল। বৃষ্টি তখনো পড়ছে, কিন্তু তাদের ভেতরটা উষ্ণতায় ভরে উঠল।
নতুন অধ্যায়
এরপর থেকে সবকিছু বদলে গেল। লাইব্রেরিতে একসাথে পড়াশোনা করা যেন আরও গভীর অর্থ পেল। ক্যান্টিনে চা খাওয়ার সময় তারা আর শুধু পড়াশোনার আলোচনা করত না, বরং ভবিষ্যৎ নিয়েও স্বপ্ন বুনত।
নীলা: “তুমি যদি একদিন দূরে চলে যাও, তখন?”
আরিয়ান: “তাহলে তোমার কাছে ফিরে আসব। কারণ আমার জানালা তো তুমি।”
নীলা: “আর যদি জানালা বন্ধ করে দিই?”
আরিয়ান: (হেসে) “তাহলে আমি অপেক্ষা করব, যতদিন না তুমি খুলে দাও।”
শেষ দৃশ্য
বছর কয়েক পর। নীলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে। পেছন থেকে পরিচিত কণ্ঠ—
আরিয়ান: “তুমি কি আবার গল্প লিখছো?”
নীলা: (হেসে ঘুরে) “হ্যাঁ। আজকের গল্পের নাম ‘হৃদয়ের জানালা’। জানো কে চরিত্র?”
আরিয়ান: (হেসে) “হয়তো আমি?”
নীলা: “হ্যাঁ, শুধু চরিত্র নও, পুরো গল্পটাই তুমি।”
আরিয়ান কাছে এসে তার হাতটা ধরে বলল—
আরিয়ান: “তাহলে এই গল্পের শেষ কখনো হবে না।”
নীলা: “না, এই গল্প চলবে যতদিন আমাদের দু’জনের নিঃশ্বাস চলবে।”
আকাশে তখন পূর্ণিমার আলো, চারপাশ ভিজে, আর দুটো হৃদয়ের জানালা খুলে গেছে একে অপরের দিকে।